মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধ হলে বাংলাদেশ ৭ দিনও টিকবেনা! | বাস্তবতা কী? Bangladesh vs Myanmar Army Power

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপকে ঘিরে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর তৎপরতা, সীমান্তে গোলাগুলি এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আরাকান আর্মির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিচরণ দুই দেশের সম্পর্ককে এক জটিল পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এই উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে একটি প্রশ্ন বারবার সামনে আসছে: যদি সত্যিই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়, তাহলে তার ফলাফল কী হবে? সম্প্রতি একটি ইউটিউব ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, "মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধ হলে বাংলাদেশ ৭ দিনও টিকবে না!" এই দাবিটি একদিকে যেমন উদ্বেগজনক, তেমনই গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

এই ব্লগপোস্টে আমরা কোনো প্রকার আবেগ বা জাতীয়তাবাদী অতিশয়োক্তিকে প্রশ্রয় না দিয়ে, সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণ থেকে দুই দেশের সামরিক সক্ষমতা, ভৌগোলিক অবস্থান, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ এবং ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, একটি সম্ভাব্য সংঘাতের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা এবং ভিডিওতে করা দাবিটির সত্যতা যাচাই করা।



অধ্যায় ১: ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট ও সীমান্ত সুরক্ষা চ্যালেঞ্জ

যেকোনো যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণে ভৌগোলিক অবস্থান এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত বিশ্বের অন্যতম জটিল এবং অস্থিতিশীল সীমান্ত এলাকাগুলোর একটি। এর একটি বড় অংশই পড়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে, যা ঘন বন, অসংখ্য ঝিরি-ঝর্ণা এবং উঁচু-নিচু ভূখণ্ড দ্বারা আবৃত।

পার্বত্য চট্টগ্রামের কৌশলগত গুরুত্ব ও চ্যালেঞ্জ:

বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় এক-দশমাংশ জুড়ে থাকা এই পার্বত্য অঞ্চল (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) প্রাকৃতিকভাবেই একটি দুর্গ। এই দুর্গম ভূখণ্ড একদিকে যেমন আক্রমণকারী বাহিনীর জন্য একটি প্রাকৃতিক বাধা তৈরি করে, তেমনই তা দেশের প্রতিরক্ষার জন্যও মারাত্মক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। ঘন জঙ্গলের কারণে এখানে শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত কঠিন। প্রচলিত যুদ্ধ কৌশলের পরিবর্তে এখানে গেরিলা যুদ্ধের প্রাদুর্ভাব ঘটার সম্ভাবনা অনেক বেশি। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাদের নিজেদের দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে দশকের পর দশক ধরে গেরিলা যুদ্ধ করে আসছে, যা তাদের এই ধরনের পরিবেশে যুদ্ধ করার জন্য অভিজ্ঞ করে তুলেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরও পার্বত্য চট্টগ্রামে কাউন্টার-ইনসারজেন্সি অপারেশনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে, কিন্তু একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে এই অভিজ্ঞতা কতটা কার্যকর হবে, তা একটি বড় প্রশ্ন।

উন্মুক্ত সীমান্ত এবং ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা:

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের একটি বড় অংশ এখনও অরক্ষিত। কাঁটাতারের বেড়ার অনুপস্থিতি এবং দুর্গমতার কারণে এই সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ, অস্ত্র চোরাচালান এবং মাদক পাচার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই দুর্বল সীমান্ত ব্যবস্থাপনা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জন্য একটি ভয়াবহ দুর্বলতা হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে। শত্রুপক্ষ খুব সহজেই এই অরক্ষিত সীমান্ত ব্যবহার করে দেশের অভ্যন্তরে কমান্ডো বা বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করতে পারে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট করার পাশাপাশি মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মনোযোগ সরিয়ে দিতে পারে।

নাফ নদী ও সমুদ্রসীমা:

স্থলভাগের পাশাপাশি নাফ নদী এবং বঙ্গোপসাগরের সীমান্তও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নাফ নদী মাদক, বিশেষ করে ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের কৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমার নৌবাহিনীর যেকোনো ধরনের আগ্রাসন প্রতিহত করতে এবং সমুদ্রপথে রসদ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে এখানে সর্বোচ্চ সক্ষমতার পরিচয় দিতে হবে। সমুদ্রসীমা অরক্ষিত থাকলে তা কেবল দেশের সার্বভৌমত্বকেই হুমকির মুখে ফেলবে না, বরং অর্থনৈতিকভাবেও বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দিতে পারে।

ভৌগোলিকভাবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গমতা বাংলাদেশের জন্য একটি 'ডাবল-এজড সোর্ড' বা দ্বিমুখী তলোয়ার। এটি যেমন প্রতিরক্ষায় সহায়তা করতে পারে, তেমনই ভুল ব্যবস্থাপনার কারণে এটিই হতে পারে পরাজয়ের অন্যতম কারণ।

অধ্যায় ২: অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা: বাংলাদেশের 'অ্যাকিলিস হিল'?

একটি দেশ তখনই বহিশত্রুর বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে লড়তে পারে, যখন তার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকে। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর কারণে অস্থিতিশীল। এটিই হয়তো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা বা 'অ্যাকিলিস হিল'।

বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস ও বর্তমান:

১৯৭৩ সালে গঠিত 'শান্তি বাহিনী'র মাধ্যমে এই অঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা হয়। ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও এই অঞ্চলে পুরোপুরি শান্তি ফিরে আসেনি। বরং সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। বর্তমানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (KNF), আরাকান আর্মি (AA), এবং আরও কয়েকটি ছোট-বড় গোষ্ঠী এই অঞ্চলে সক্রিয়। এই গোষ্ঠীগুলো চাঁদাবাজি, অপহরণ, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং প্রায়শই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয়।

গোয়েন্দা ব্যর্থতা এবং সমন্বয়হীনতা:

ভিডিওতে উল্লেখিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (KNF) মতো একটি সশস্ত্র সংগঠন যখন ধীরে ধীরে সংগঠিত হচ্ছিল, প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল এবং এমনকি নিজেদের জন্য ইউনিফর্ম তৈরি করছিল, তখন দেশের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কেন তার পূর্বাভাস পেতে ব্যর্থ হলো? এই ধরনের অভ্যন্তরীণ হুমকি সময়মতো চিহ্নিত করে নির্মূল করতে না পারাটা একটি বড় ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতারই ইঙ্গিত দেয়। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই দুর্বলতা আরও প্রকট হয়ে উঠবে।

অভ্যন্তরীণ 'দ্বিতীয় ফ্রন্ট':

যদি মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের যুদ্ধ শুরু হয়, তবে এই অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশের জন্য একটি ভয়ংকর 'দ্বিতীয় ফ্রন্ট' তৈরি করতে পারে। তারা শত্রুপক্ষের কাছ থেকে অর্থ ও অস্ত্রের বিনিময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রসদ সরবরাহ লাইন আক্রমণ করতে পারে, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালাতে পারে এবং দেশের অভ্যন্তরে অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে একই সাথে দুটি ফ্রন্টে (সীমান্তে এবং দেশের অভ্যন্তরে) লড়াই করতে হবে, যা সামরিক বাহিনীর শক্তি এবং মনোযোগকে বিভক্ত করে ফেলবে। মিয়ানমার এই সুযোগটি পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করার চেষ্টা করবে, যা যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণে একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আরাকান আর্মির মতো গোষ্ঠী, যারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তারাও প্রয়োজনে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করতে পারে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।

সুতরাং, সীমান্তে শত্রু মোকাবেলার আগে বাংলাদেশকে নিজেদের ঘর সামলাতে হবে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে, কেবল সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে যুদ্ধ জয় করা প্রায় অসম্ভব।

অধ্যায় ৩: রোহিঙ্গা সংকট: মানবিকতার বোঝা নাকি কৌশলগত ভুল?

২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত দমনের শিকার হয়ে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশ সরকার মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের আশ্রয় দিলেও, এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থী জনগোষ্ঠী এখন দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বিরাট বোঝায় পরিণত হয়েছে।

সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা:

ভিডিওতে কঠোরভাবে সমালোচনা করে বলা হয়েছে যে, প্রায় ১২ থেকে ১৫ লক্ষ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং সামরিক বাহিনীর দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে। একটি সার্বভৌম দেশের সীমান্ত এত সহজে ভেদ করে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রবেশ করতে পারে না, যদি না সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের ঘাটতি থাকে। মানবিক কারণগুলো গুরুত্বপূর্ণ হলেও, জাতীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে এই অবাধ অনুপ্রবেশ একটি বড় কৌশলগত ভুল ছিল বলে অনেকে মনে করেন।

নিরাপত্তার হুমকি রোহিঙ্গা ক্যাম্প:

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো এখন অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। মাদক ব্যবসা, অস্ত্র চোরাচালান, অপহরণ, এবং হত্যার মতো ঘটনা সেখানে নিয়মিত ঘটছে। ক্যাম্পগুলোর অভ্যন্তরে 'আরসা' (ARSA) সহ বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে, যারা নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রায়ই সংঘাতে লিপ্ত হয়। এই গোষ্ঠীগুলোর হাতে রয়েছে আধুনিক অস্ত্র, যা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি।

যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য ভূমিকা:

যদি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে এই বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী একটি 'ওয়াইল্ড কার্ড' হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। তাদের একটি অংশ হয়তো বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবে, কিন্তু আরেকটি বড় অংশকে মিয়ানমার বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারে। তারা গুপ্তচরবৃত্তি, অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ এবং সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তুলতে পারে। মিয়ানমার যদি তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এই বিপুল এবং অনেকাংশে अनियन्त्रিত জনগোষ্ঠীকে সামাল দেওয়া যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি দুঃসাধ্য কাজ হবে।

মানবিকতার খাতিরে নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত যে কীভাবে একটি দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তাজনিত মাথাব্যথার কারণ হতে পারে, রোহিঙ্গা সংকট তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

অধ্যায় ৪: মাদকের চোরাচালান: নীরব অর্থনৈতিক যুদ্ধ

মিয়ানমার থেকে, বিশেষ করে 'গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল' থেকে আসা ইয়াবা এবং আইসের মতো সিন্থেটিক মাদকের ভয়াবহ স্রোতে বাংলাদেশ ভাসছে। এটি কেবল একটি সামাজিক সমস্যা নয়, এটি একটি নীরব অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, যা বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এবং দেশের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে ক্ষয় করে দিচ্ছে।

অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং সামাজিক অবক্ষয়:

আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৬০,০০০ কোটি টাকার মাদক বাংলাদেশে প্রবেশ করে, যার প্রায় ৮০ শতাংশই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়িয়ে যায়। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে এবং তা সরাসরি মিয়ানমারের বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং সিন্ডিকেটের হাতে পৌঁছাচ্ছে, যা তাদের আরও শক্তিশালী করছে। অন্যদিকে, মাদকের করাল গ্রাসে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে, যা দেশের কর্মক্ষম জনশক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ব্যর্থতা:

এই ভয়াবহ মাদক চোরাচালান রোধে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং অন্যান্য বাহিনীর ব্যর্থতা অত্যন্ত স্পষ্ট। দুর্নীতির অভিযোগ, সমন্বয়হীনতা, এবং আধুনিক প্রযুক্তির অভাব এর অন্যতম কারণ। যখন একটি দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী মাদক চোরাচালানের মতো বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তখন সেই বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এই একই বাহিনী একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে শত্রুর আগ্রাসন কীভাবে প্রতিহত করবে?

মাদক চোরাচালানকে কেবল একটি অপরাধ হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের (বা সেখানকার বিভিন্ন গোষ্ঠীর) একটি পরিকল্পিত 'প্রক্সি ওয়ার' বা ছায়া যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কোনো গুলি বা বোমা ব্যবহার করা হচ্ছে না, কিন্তু এর প্রভাব একটি প্রচলিত যুদ্ধের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

অধ্যায় ৫: সামরিক শক্তির তুলনামূলক বিশ্লেষণ: কাগজে-কলমে কে এগিয়ে?

যেকোনো যুদ্ধের আলোচনা সামরিক শক্তির তুলনা ছাড়া অসম্পূর্ণ। আসুন, কাগজে-কলমে দুই দেশের সামরিক শক্তির একটি তুলনামূলক চিত্র দেখা যাক।

  • প্রতিরক্ষা বাজেট: আপাতদৃষ্টিতে, বাংলাদেশ এখানে এগিয়ে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার, যা মিয়ানমারের ২.৭ বিলিয়ন ডলারের প্রায় তিনগুণ। কিন্তু বাজেট বেশি হলেই সামরিক শক্তি বেশি হয় না। সেই বাজেটের সঠিক ব্যবহার, আধুনিক সরঞ্জাম ক্রয়, প্রশিক্ষণ এবং দুর্নীতিরোধের উপর সক্ষমতা নির্ভর করে।

  • সৈন্য সংখ্যা: মিয়ানমারের সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা (প্রায় ১৫০,০০০) বাংলাদেশের (প্রায় ১০৮,০০০) চেয়ে বেশি। তবে বাংলাদেশের একটি বিশাল আধাসামরিক বাহিনী রয়েছে (প্রায় ৪.৮ মিলিয়ন আনসার ও ভিডিপি), যাদের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু এই সহায়ক বাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং সরঞ্জাম অত্যন্ত সীমিত। অন্যদিকে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দশকের পর দশক ধরে অভ্যন্তরীণ সংঘাতে লিপ্ত থাকায় তাদের যুদ্ধ অভিজ্ঞতা অনেক বেশি।

  • স্থল শক্তি: স্থল শক্তিতে মিয়ানমার পরিষ্কারভাবে এগিয়ে। তাদের ট্যাঙ্কের সংখ্যা বাংলাদেশের দ্বিগুণেরও বেশি। সাঁজোয়া যান এবং আর্টিলারির ক্ষেত্রেও তারা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কের সংখ্যাগত সুবিধা একটি বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।

  • বিমান শক্তি: মিয়ানমারের বিমান বাহিনীর আকার (২৯৩টি এয়ারক্রাফট) এবং অভিজ্ঞতা, উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের (২১৬টি এয়ারক্রাফট) চেয়ে এগিয়ে। তারা নিয়মিতভাবে তাদের যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টারগুলো অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে, যা তাদের পাইলটদের অনেক বেশি অভিজ্ঞ করে তুলেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর যুদ্ধ অভিজ্ঞতা প্রায় নেই বললেই চলে এবং তাদের ট্রেনিং বিমানগুলোর ঘন ঘন দুর্ঘটনা বাহিনীর প্রস্তুতির উপর প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করেছে।

  • নৌ শক্তি: মিয়ানমারের নৌবাহিনীর দ্রুত আধুনিকায়ন ঘটছে। তাদের যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা (৩৬২টি) বাংলাদেশের (১৯০টি) চেয়ে অনেক বেশি। যদিও বাংলাদেশ ২০১৭ সালে চীন থেকে দুটি পুরোনো সাবমেরিন সংগ্রহ করেছে, কিন্তু সেগুলোর প্রকৃত কার্যকারিতা এবং রক্ষণাবেক্ষণের সক্ষমতা এখনও প্রমাণিত নয়। বঙ্গোপসাগরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

কাগজে-কলমের এই পরিসংখ্যান থেকে এটি স্পষ্ট যে, প্রচলিত সামরিক সরঞ্জামের দিক থেকে এবং যুদ্ধ অভিজ্ঞতার নিরিখে মিয়ানমার বাংলাদেশের চেয়ে কিছুটা হলেও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।

অধ্যায় ৬: সম্ভাব্য যুদ্ধের ফলাফল: ৭ দিনের তত্ত্বের বাস্তবতা কতটুকু?

এবার আমরা মূল প্রশ্নে ফিরে আসি। ভিডিওতে করা "বাংলাদেশ ৭ দিনও টিকবে না" - এই দাবিটি কতটা বাস্তবসম্মত?

বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দাবিটি একটি চরম দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন হলেও এর পেছনের যুক্তিগুলোকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদি একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু হয় এবং মিয়ানমার তার সর্বশক্তি দিয়ে একটি 'ব্লিৎসক্রিগ' বা ঝটিকা আক্রমণ পরিচালনা করে, তবে বাংলাদেশের জন্য প্রথম কয়েকদিন অত্যন্ত কঠিন হবে।

বাংলাদেশের দুর্বলতাগুলো:

১. অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ: KNF এবং অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো যদি 'দ্বিতীয় ফ্রন্ট' খুলে দেয়, তবে তা বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দেবে।

২. রোহিঙ্গা সংকট: রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অস্থিতিশীলতা এবং তাদের সম্ভাব্য শত্রুপক্ষ দ্বারা ব্যবহৃত হওয়ার ঝুঁকি একটি বড় উদ্বেগের কারণ।

৩. সীমান্ত দুর্বলতা: অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে শত্রুর অনুপ্রবেশ ঠেকানো কঠিন হবে।

৪. যুদ্ধ অভিজ্ঞতার অভাব: মিয়ানমারের তুলনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক যুদ্ধ অভিজ্ঞতা কম।

বাংলাদেশের শক্তি:

১. দেশপ্রেমিক জনশক্তি: যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকবে, যা যেকোনো আক্রমণকারী শক্তির জন্য একটি বড় বাধা।

২. জনসংখ্যার ঘনত্ব: বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশে প্রচলিত যুদ্ধ পরিচালনা করা আক্রমণকারী বাহিনীর জন্য অত্যন্ত কঠিন। আরবান ওয়ারফেয়ার বা শহুরে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে তা আক্রমণকারীদের জন্য একটি দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে।

৩. প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ: বাংলাদেশ যদি নিজেদের ভূখণ্ডে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ করে, তবে তারা ভৌগোলিক সুবিধাগুলো কাজে লাগাতে পারবে।

৪. আন্তর্জাতিক সমর্থন: যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ আসবে। ভারত এবং চীনের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। তারা কোনো পক্ষকে সরাসরি সমর্থন না দিলেও, স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করবে।

অতএব, '৭ দিনে পতন' - এই ধারণাটি কিছুটা অতি সরলীকরণ। বাংলাদেশ হয়তো শুরুতে বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে, কিন্তু দেশের পতন ঘটা বা পুরোপুরি দখল হয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। যুদ্ধ ৭ দিনের চেয়ে অনেক বেশি দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এটি কোনো পক্ষের জন্যই লাভজনক হবে না। এটি একটি রক্তক্ষয়ী এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে রূপ নিতে পারে, যা উভয় দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেবে।

উপসংহার

যুদ্ধ কেবল সামরিক সরঞ্জাম বা সৈন্য সংখ্যার খেলা নয়। এর ফলাফল নির্ভর করে জাতীয় ঐক্য, কৌশলগত দূরদর্শিতা, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং কূটনৈতিক দক্ষতার উপর। মিয়ানমারের সাথে সম্ভাব্য সংঘাতের বিশ্লেষণ থেকে এটি পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের বেশ কিছু গুরুতর দুর্বলতা রয়েছে, যা উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।

পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রোহিঙ্গা সমস্যার একটি টেকসই এবং স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা, এবং দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন করা এখন সময়ের দাবি। সামরিক সরঞ্জামের আধুনিকায়নের পাশাপাশি গোয়েন্দা সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের উপর আরও জোর দিতে হবে।

যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। এটি কেবল ধ্বংস ডেকে আনে। তবে, "শান্তির জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি" - এই প্রাচীন প্রবাদটি আজও সত্য। বাংলাদেশকে তার সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় অখণ্ডতা রক্ষার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। আর সেই প্রস্তুতি কেবল সামরিক ক্ষেত্রে হলেই চলবে না, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ সব দুর্বলতা দূর করার মাধ্যমেই প্রকৃত শক্তি অর্জন সম্ভব।

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url