(সত্য জানুন) মার্কিন ঘাটি স্থাপনে জিয়াউর রহমান সম্মতি দিয়েছিলেন?

প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর মার্কিন-সোভিয়েত কোল্ড ওয়ারে দক্ষিণ এশিয়ার জটিল বৈশ্বিক কৌশলগত পরিস্থিতিতে ছিল। ভারতের মর্যাদাপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ঢাকার জন্য নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। ভীতু ভারতীয় পরিকল্পনায় দেখা গেছে যে, একটি সংকটাপন্ন বাংলাদেশ “যদি প্রয়োজন হয়, যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের হাতে সামরিক ঘাঁটি দিতে পারে” এ আশংকা নিয়ে চিন্তা করতmarines.mil। অর্থাৎ, ভারতের নিরাপত্তা পরিকল্পনাকারীদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের বিপরীতে কোনো সামরিক জোটের অংশ না হওয়ার কারণে বাংলাদেশের ওপর একটি বিস্তৃত নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি, যাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশকে ঘাঁটি বানানোর সুযোগ না আসেmarines.mil

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের (১৯৭৫) পর ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমানের সরকার বিদেশনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক বাড়াতে চেয়েছিল। অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও উন্নয়ন সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্ব পেয়েছিল। ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর প্রকাশ করেছে একটি গোপন ব্রিফিং মেমোর্যান্ডামে, ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত এডওয়ার্ড মাস্টার্সের পরামর্শ উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে: জিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব’ নিতে চেয়েছিলেনhistory.state.gov। এর মানে, তিনি চাইছিলেন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সুরক্ষার দায়িত্ব নিক, সম্ভবত সামরিক সহযোগিতা বা উপস্থিতি বাড়িয়ে।

জিয়াউর রহমানের নীতি ও মার্কিন প্রত্যাশা

জিয়া মিত্রশাসনের প্রারম্ভে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা চেয়েছিলেন। সাদৃশ্যপূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে ফ্রান্সের কাগজপত্র (Foreign Relations of the United States, 1977–1980) থেকে জানা যায় যে, জিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নিতে বলেছেনhistory.state.gov। তবে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাস্টার্স সতর্ক করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি টান টানিয়ে ঢাকায় অনেকটা জড়িয়ে পড়ে তবে তা ব্যর্থ হবে এবং আমেরিকার সীমিত অর্থনৈতিক সাহায্যও ঝুঁকির সম্মুখীন হবেhistory.state.gov। অর্থাৎ, জিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্তাব ছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেটি এগিয়ে নিতে চাইেনি।

 

জিয়া ১৯৮০ সালে জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশনে অংশ নিতে আমেরিকা গেলে কার্টার প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী তিনি নিজের দেশে সামরিক বাহিনী গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছিলেনbdtoday.net। তিনি উল্লেখ করেছিলেন সশস্ত্র বাহিনী গড়ার জন্য বাংলাদেশে কিছু রাডার, বিমান ও নৌবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র নৌকা প্রয়োজন। তবে এই কোনো এক চুক্তি বা ঘাঁটির বিশেষ উল্লেখ করেননি। সেদিক থেকে দেখা যায়, জিয়া চেয়েছিলেন আমেরিকা সামরিক দিক থেকে অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশকে সাহায্য করুক, কিন্তু বাংলাদেশে কোনো স্থায়ী মার্কিন ঘাঁটি দেয়ার জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক অনুমোদন জিয়া প্রদান করেননি


মার্কিন আগ্রহ ও প্রস্তাবনা

বিপরীত দিকে, আমেরিকার কেউ কেউ—বিশেষ করে হিমশীতল যুদ্ধ কৌশলে—বাংলাদেশকে উপযুক্ত অবস্থান বিবেচনা করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, জোসেফ ফারল্যান্ড (১৯৬৯ সালে পাকিস্তানে আমেরিকান দূত) পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের জোর করেছিল যে তারা বিচ্ছিন্নতা আন্দোলন করলে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ও সামরিক সাহায্য দেবে; তবে বিনিময়ে তাদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ (সহ মণপুরা) যুক্তরাষ্ট্রকে হস্তান্তর করতে হবেidsa.in। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে নতুন সরকার গঠন হলেই আমেরিকান রণনীতিবিদরা এই দ্বীপটি ঘাঁটি হিসেবে ভেবে দেখেছিল। আবার ১৯৭৪ সালে পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার ঢাকায় আসার সময় মার্কিন প্রেসক্রিপশনে মুজিবকে ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা’ দেওয়ার আশ্বাস দেন বিনিময়ে গোপনে সেন্ট মার্টিন-এর নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তরেরidsa.in। মুজিব এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

 

পরবর্তীকালে ১৯৮০-এর দশকের গোড়ায় সোভিয়েত এক সামরিক বিশ্লেষক জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরে বিভিন্ন ঘাঁটি স্থাপন করতে চাইছে, যার জন্য বাংলাদেশের দুটি দ্বীপ (সেন্ট মার্টিন ও মণপুরা) অন্যতম সম্ভাব্য স্থান হিসেব করা হচ্ছেidsa.in। এরপরে ১৯৮৪ সালে মার্কিন উপ-প্রশাসনিক জেনারেল জেমস লি বাংলাদেশ সফরে আসেন। পাকিস্তানের সাবেক নৌঘাঁটির সম্মুখে সম্মুখ কৌশলগত সুবিধা পাওয়া এবং ৭ম নৌ-ফ্লিটের জরুরি বিমান অবতরণের সুবিধা নিয়ে আলোচনা হয়। এর পরেই তৎকালীন প্যাসিফিক কমান্ডের তিন সিনিয়র কর্মকর্তা চট্টগ্রাম, সেন্ট মার্টিন ও মণপুরা দ্বীপ পরিদর্শন করেন। তথ্য অনুযায়ী, তারা চট্টগ্রামে জরুরি অবতরণ সুবিধা নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি দুই দ্বীপে মার্কিন নৌঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনাও তদন্ত করে দেখেছিলেনidsa.in। তবে দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত সরকারের কাছে কোনো ঘাঁটি অনুমোদিত হয়নিidsa.in

অনুমোদন-বিষয়ক প্রশ্ন ও স্থানীয় প্রতিবাদ

১৯৮৬ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন ওয়েস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটিন্যান্ট জেনারেল চার্লস বি. বেগারাল এবং একই বছরের ডিসেম্বর মাসে প্যাসিফিক কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল হেইজ ঢাকা সফর করেন। এসব সফরেও স্থানীয় গণমাধ্যমে সেন্ট মার্টিনে মার্কিন ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাবনার আলোচনা ওঠেidsa.in। তবে সেসব সময় মার্কিন কর্তৃপক্ষ সরাসরি অস্বীকার করে জানান যে তাদের কোনও ঘাঁটির ন্যূতিপূর্ণ পরিকল্পনা নেইidsa.in। ইউএসএমের বিবৃতি অনুসারে, ভারত-পাকিস্তানে সামরিক গুটির উত্তেজনার অবসান ও ভিস্তা সেতু ইস্যুতে কূটনৈতিক আপসের মাধ্যমে পরিস্থিতি বদলের কারণে আমেরিকার পূর্বপুরুষের মনোভাবও পরিবর্তিত হয় এবং মার্কিন ইউএস সশস্ত্র বাহিনী ইতোমধ্যেই ভারত মহাসাগরে ডিজেঘো গার্সিয়া ঘাঁটির সমাধানে দেখছিল।

 

এছাড়া যুগের শেষের দিকে বাঙালি জনমনে প্রচলিত ছিল যে বাংলাদেশ নিরপেক্ষ ও অযৌথ কোনো সামরিক চুক্তি চায় না। স্থানীয় রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবি গোষ্ঠী সামরিক জোট বা ঘাঁটির বিরোধিতা করে আসতো। ১৯৮০-এর দশকের এই স্মৃতিপত্র অনুযায়ী, “বাংলাদেশের জনগণ ঐতিহ্যগতভাবে সামরিক জোটের বিরোধী ও নিরপেক্ষতাবাদী;” ফলে যেকোনো মার্কিন ঘাঁটি চাওয়া হোক না কেন সাধারণভাবে তা সমর্থিত হতো নাidsa.in

উপসংহার

এভাবে দেখা যায় যে জিয়া সরকারের আমলে বাংলাদেশে কোনও মার্কিন সামরিক ঘাঁটি প্রকৃতপক্ষে স্থাপনের জন্য আনুষ্ঠানিক কোনো চুক্তি বা অনুমোদন হয়নি। বরং উভয়পক্ষই এ ব্যাপারে সাবধান ছিল। মার্কিন দপ্তরের গোপন নথিতে স্পষ্ট যে, ১৯৭৭ সালে জিয়া আমেরিকাকে বাংলাদেশের সুরক্ষা ব্যবস্থা চালানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু আমেরিকা সেটি প্রত্যাখ্যান করেছিলhistory.state.gov। পরবর্তীকালে মার্কিন পেশাদার ও সামরিক কর্মকর্তারা ঢাকায় ঘাঁটির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখলেও স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের কারণে কোনো ঘাঁটিতে সম্মতি দেয়া হয়নিidsa.inidsa.in। ফলে ঐতিহাসিক ও কূটনৈতিক দলিলসমূহ থেকে এই প্রমাণ পাওয়া যায় যে জিয়াউর রহমান মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক সম্মতি দেননিhistory.state.govidsa.in

 

তথ্যসূত্র: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের গোপন নথি ও ব্রিফিং ম্যামোর্যান্ডাম (FRUS)history.state.gov; ভারতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা সংস্থা আইডিএসএ-এর প্রতিবেদনidsa.inidsa.in; মার্কিন সামরিক বিশ্লেষণ (বাংলাদেশ: কন্ট্রি স্টাডি)marines.mil

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url